শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৮ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক : চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে মানবজাতি। মহামারি করোনা ছোবল থেকে বাঁচতে ও বাঁচাতে নানা পদক্ষেপে রয়েছে অজানা আতঙ্ক। ঘরে ঘরে চলছে নিরন্ন মানুষের হাহাকার। সর্বোচ্চ ধনীদের জন্য দেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ প্রনোদনা। ঘরে বসেই বেতন পাচ্ছেন সরকারের কর্মচারীরা। বৈশাখী ভাতাও বাদ যায়নি। যদিও রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষ থেকে ডিজিটাল উপায়ে বৈশাখী পালনের নির্দেশ এসেছে। মধ্যবিত্ত মানুষদের মধ্যে চলছে লজ্জা, ভয় আর চাপা হাহাকার। কর্মের খোঁজে ঘর থেকে বের হলেই রয়েছে নানা রকম শাস্তি ও অর্থদন্ড। এ পর্যায়ে কয়েকটি গল্প দিয়েই আমার এ লেখাটি শেষ করতে চাই।
খলিফা হারুন-অর রশিদের আমল। একজন বৃদ্ধা মহিলাকে আসামী হিসেবে নতুন বিচারকের দরবারে হাজির করলেন। তার অপরাধ ছিল তিনি শহরের এক রেস্তারাঁ থেকে কিছু রুটি আর মধু চুরি করেছে। আত্মপক্ষ সমর্থন করে আসামী জানালেন এক সপ্তাহ যাবত এতিম দু’নাতি সহ তিনি অনাহারে ছিলেন। নাতিদের ক্ষুধারত চেহারা ও কান্না সহ্য করতে না পেরে এ চুরির ঘটনা ঘটেছে। বিচারক এবার পুরো দরবারে চোখ বুলালেন। বললেন কাল যেন নগর, খাদ্য, শরিয়া, পুলিশ প্রধান ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গের উপস্থিতিতে এ রায় দেয়া হবে। পরদিন সকালে সবাই হাজির হলেন। বিচারক ও যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে রায় ঘোষণা করলেন-“বৃদ্ধা মহিলার চুরির অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ৫০টি চাবুক, ৫০০ দিণার রৌপ্য মুদ্রা আর অনাদায়ে এক বছর কারাদ- প্রদান করা হলো। তবে অকপটে সত্য বলার কারণে হাত কাটা মাফ করা হলো।
এবার বিচারক প্রহরীকে চাবুক আনার নির্দেশ দিয়ে নিচে নেমে ঐ বৃদ্ধা মহিলার পাশে এসে দাঁড়ালেন । বিচারক বললেন যে নগরে একজন ক্ষুধার্ত বৃদ্ধ মহিলা না খেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণায় চুরি করতে বাধ্য হয় সেখানে তো সবচেয়ে বড় অপরাধী সে দেশের খলিফা। আর আমি এসেছি খলিফার প্রতিনিধি হয়ে। আমি যেহেতু তাঁর অধীনে চাকরি করি তাই ৫০টি চাবুকের ২০টি আমার হাতে মারা হউক আর এটাই হলো বিচারকের আদেশ। আদেশ যেন পালন করা হয় এবং বিচারক হিসাবে আমার উপর চাবুক মারতে যেন কোনো রকম করুণা বা দয়া দেখানো না হয়।
বিচারক হাত বাড়িয়ে দিলেন। দুই হাতে পর পর ২০টি চাবুক মারা হলো। চাবুকের আঘাতের ফলে হাত থেকে রক্ত গড়িয়ে পরছে। এরপর বিচারক বললেন “যে শহরে নগর প্রধান, খাদ্য গুদাম প্রধান ও অন্যান্য সমাজ হিতৈষীরা একজন অভাবগ্রস্থ মহিলার ভরন-পোষণ করতে পারেন না। সেই নগরে তারাও অপরাধী। তাই বাকি ৩০টি চাবুক সমান ভাবে তাদেরকে মারা হোক।”
এরপর বিচারক নিজ পকেট থেকে বের করা রুমালের উপর ৫০টি রৌপ্য মুদ্রা রাখলেন। তারপর বিচারপতি উপস্থিত সবাইকে বললেন “যে সমাজ একজন বৃদ্ধমহিলাকে চোর বানায়, যে সমাজে এতিম শিশুরা উপবাস থাকে সে সমাজের সবাই অপরাধী। তাই উপস্থিত সবাইকে ১০০ দিণার রৌপ্য মুদ্রা জরিমানা করা হলো।”
এবার মোট ৫০০ দিনার রৌপ্য মুদ্রাথেকে ১০০ দিণার রৌপ্য মুদ্রা জরিমানাবাবদ রেখে বাকি ৪০০টি রৌপ্য মুদ্রা থেকে ২০টি চুরি যাওয়া দোকানের মালিককে দেওয়া হলো। বাকি ৩৮০টি রৌপ্য মুদ্রা বৃদ্ধা মহিলাকে দিয়ে বললেন “এগুলো আপনার ভরণপোষণের জন্য। আর আগামী মাসে আপনি খলিফা হারুন-অর রশিদের দরবারে আসবেন। খলিফা আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থী।
এবার খলিফার দরবারে হাজির ওই বৃদ্ধা। বিচারক চেয়াার থেকে নেমে এসে বললেন আপনাকে ও আপনার এতিম দু’নাতিকে উপোস রাখার জন্য সেদিন বিচারক হিসেবে ক্ষমা চেয়েছিলাম । আজ দরবারে ডেকে এনেছি প্রজা অধিকার সমুন্নত করতে না পারা অধম এই খলীফাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য। আপনি দয়া করে আমাকে ক্ষমা করুন।
এটা ভিন্ন গল্প। একরাতে নৈশভ্রমণে বের হয়েছেন খলিফা। মূলত এ ভ্রমণে তিনি রাজ্যের নাগরিকের সুখ-দুঃখের খোঁজ নিতেন। সে রাতে ছিল চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছু দূর যেতেই বাচ্চাদের কান্নার শব্দ শোনা গেলেও অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে সামনের দিকে এগোতে হলো। বেশ কিছু বালুময় বিস্তীর্ণ পথ পাড়ি দেওয়ার পর কান্নার আওয়াজ আসা স্থানটি নির্ণয় করা গেল। দেখা গেল নিভুনিভু আগুনের চিহ্ন। আরও কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনা অবলোকন করার চেষ্টা করছেন খলিফা ও তার সঙ্গী। প্রথম বোঝা গেল এক মহিলা চুলায় কিছু রান্না করছেন। তার পাশে দুই শিশু খাবারের জন্য কান্না করছে। অথচ মহিলাটি বাচ্চাদের অতি শিগগিরই খাবার দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে বেশকিছু সময় অতিবাহিত হলো। তারা দুজন ঠায় দাঁড়িয়ে এসব চিত্র দেখে যাচ্ছেন। এসব চিত্র দেখার ফাঁকে-ফাঁকে তারা নিজেদের মধ্যে কিছু ছোট ছোট আলাপও করছেন। এরই মধ্যে তাদের কাছে আরও স্পষ্ট হলো বিষয়টি। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও বাচ্চাদের দেওয়া মহিলার স্বল্প সময়ের আশ্বাস ফুরাচ্ছে না। তখন তারা আগন্তুক হিসেবে মহিলার দিকে এগিয়ে গেলেন। একজন আগন্তুকের বয়স খানিকটা বেশি হলেও অপরজন ছিল যুবক। আগন্তুকরা জিজ্ঞেস করল বাচ্চাদের এভাবে কান্নার প্রকৃত কারণ কী?
তখন মহিলা অত্যন্ত অসহায়তার সঙ্গে বলতে লাগলেন, এই দুই বাচ্চা আমার সন্তান, আমার স্বামী যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। আমি সারা দিন চেষ্টা করেও তাদের জন্য কোনো খাদ্য সংগ্রহ করতে পারিনি। তাই তাদের সান্ত¡না দেওয়ার জন্য পাতিলের মধ্যে পাথর সিদ্ধ করছি এবং অপেক্ষা করছি কখন তারা কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। তখন আগন্তুকদের মধ্যে প্রথমজন খুব মর্মাহত হলেন এবং পাশের যুবককে তাদের খাবারের জন্য নিজ কাঁধে করে আটা এবং খেজুর নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে খাদ্য নিয়ে ফিরে এলেন যুবক। এর অল্প সময় পরই মহিলা জানতে পারলেন তার জন্য খাদ্য বহন করে নিয়ে আসা ব্যক্তিই খলিফা হারুন অর রশীদের পুত্র মুহতাসীম।
এবার এ গল্পটি দিয়েই লেখাটি শেষ করতে চাই। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) একদা এক ব্যক্তির কাছ থেকে ভালোভাবে দেখেশুনে একটি ঘোড়া ক্রয় করলেন। অতঃপর ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে স্বীয় গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হলেন। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর ঘোড়াটি অসুস্থ হয়ে পড়ল এবং খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে লাগল। ওমর (রা.) কালবিলম্ব না করে সরাসরি বিক্রেতার কাছে ফিরে এলেন এবং তাঁকে বললেন, ‘তুমি তোমার ঘোড়া ফিরিয়ে নাও, এটা ত্রুটিযুক্ত।’ বিক্রেতা বললেন, ‘হে আমিরুল মুমিনিন! আমি ঘোড়াটি ফেরত নেব না। কেননা আপনি তা সুস্থ ও সবল অবস্থায়ই আমার কাছ থেকে ক্রয় করেছেন।’ ওমর (রা.) বললেন, ‘ঠিক আছে, তাহলে তোমার ও আমার মাঝে একজন বিচারক নির্ধারণ করো।’ বিক্রেতা বললেন, ‘ঠিক আছে, কাজি শুরাইহ আমাদের মধ্যে ফয়সালা করবেন।’ তাঁরা উভয়ই শুরাইহের উদ্দেশে রওনা হলেন এবং তাঁর কাছে পৌঁছে তাঁকে প্রকৃত ঘটনা বিবৃত করলেন। কাজি শুরাইহ ঘোড়ার মালিকের অভিযোগ শ্রবণ করে ওমর (রা.)-কে বললেন, ‘আপনি কি ঘোড়াটি সবল ও সুস্থ অবস্থায় কিনেছিলেন?’ ওমর (রা.) বললেন, ‘জি, হ্যাঁ।’ বুদ্ধিমত্তা ও ন্যায়পরায়ণতার মূর্ত প্রতীক কাজি শুরাইহ ঘোষণা করলেন, ‘হে আমিরুল মুমিনিন! আপনি যা ক্রয় করেছেন তা গ্রহণ করে সন্তুষ্ট হোন অথবা যে অবস্থায় ঘোড়াটি গ্রহণ করেছিলেন, সে অবস্থায় ফেরত প্রদান করুন।’ হকচকিত খলিফা মুগ্ধ দৃষ্টিতে কাজি শুরাইহের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ! এটাই তো ন্যায়বিচার। হে বিচারপতি! আপনি কুফায় গমন করুন। আমি আপনাকে কুফার প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দান করলাম। ’ (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়াহ : ৯/২৫)
পাঠক নিশ্চয়ই আপনারা স¤্রাট আলাউদ্দীন খিলজীর নাম শুনেছেন। যিনি দিল্লিতে বসে ভারতীয় উপমহাদেশে খিলজি শাসন পরিচালনা করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন ভারতীয় ইতিহাসেও একজন আলেকজেন্ডারের মতো শক্তিশালী কারো কথা উল্লেখ করা থাকুক। এজলাস ত্যাগের আগে স¤্রাট আলাউদ্দীন খিলজী কাজীকে বলেছিলেন, “আজ আপনি যদি আমার প্রতি কোনো প্রকার দুর্বলতা দেখাতেন তবে এই চাবুক নিয়েই এসেছিলাম যে, এটা দিয়েই আপনাকে শাস্তি দিতাম।” আর অপরদিকে, কাজীও তাঁর এজলাসে গোপনে রক্ষিত চাবুক দেখিয়ে সুলতানকে বলেছিলেন, “আপনি যদি আজ এজলাসে না এসে কোনো তালবাহানার আশ্রয় নিতেন তবে আমিই সরাসরি রাজদরবারে গিয়েই আপনাকে এ চাবুক দিয়ে আঘাত করতামই।”
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, গবেষক, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮